August 27, 2017, 3:33 pm, By Tahsina Tabassum Shrabanti

কবি আব্দুল হাকিম আজ থেকে চারশত বছর আগে অতি আক্ষেপের সাথে এই কবিতাটি লিখেছিলেন। এ থেকে এটাই জানা যায় যে তখনো এদেশে এমন কিছু লোক ছিল যারা বঙ্গদেশে জন্মগ্রহণ করা সত্বেও এ দেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে ঘৃর্ণা করতো। তাদের বিশ্বাস ছিল ঈশ্বর বাংলা ভাষা বুঝেন না, ঈশ্বর বুঝেন ধর্মীয় ভাষা। তা হতে পারে সংস্কৃত, ফারসি, আরবি, পালি কিংবা হায়ারোগ্লিফিক্স। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ এই তিন ধর্মের মানুষই মূলত বাংলাদেশে বসবাস করতো। পরবর্তীতে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের আগমনের পর খ্রীস্টান ধর্মেরও কিছুটা প্রসার ঘটে। এই সকল ধর্মের মানুষই এদেশের আলো, বাতাস গ্রহণ করতো, এদেশের মাটিতে জন্মানো শস্য খেয়ে জীবন ধারণ করতো, এদেশের নদীর মাছ খেয়ে আমিষের অভাব মিটাতো, এদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হতো আর কথাও বলতো বাংলা ভাষায়, কিন্তু তারা এদেশকে, এদেশের ভাষাকে মনে প্রাণে ভালবাসতো না। তারা প্রতেক্যে তাদের ধর্মীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভালবাসতো। তাহলে তারা কি নিজ দেশেই পরবাসী ছিল?
ইংরেজ আমলে দেখা যায় এদেশের শিক্ষিত সমাজের অনেকেই ইংরেজদের তোষামোদ করতো। কেউ চাকুরীর জন্য, কেউ জমিদারী টিকিয়ে রাখার জন্য, কেউ খেতাব পাওয়ার জন্য, কেউ সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য। তারা এদেশের স্বাধীনতা চায়নি চেয়েছে ইংরেজদের দাসত্ব। তাদের মধ্যে প্রথম দিকে হিন্দুদের সংখ্যা বেশী থাকলেও শেষের দিকে মুসলমানের সংখ্যাও দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইংরেজ আমলে যারা সমাজের মাথা ছিল তারা এদেশকে ভালবাসতেন কিনা জানি না কিন্তু তাদের স্ব-স্ব ধর্মকে খুবই ভালবাসতেন। তখনকার আমাদের রাজনৈতিক নেতাগণ ধর্মের ভিত্তিতেই ভারতকে দুইভাগে ভাগ করলেন। কেউ জাতীয় রাষ্ট্রের কথা ভাবলেন না। আসলে তারা তাদের জাতিয়তায় বিশ্বাসী ছিলেন না, বিশ্বাসী ছিলেন ধর্মে। যার ফলে বাংলা দুইভাগ হয়ে অর্ধেক পেল পূর্ব পাকিস্তান, আর বাকী অর্ধেক পেল ভারত। একটা জাতিকে কেটে টুকরো করে তারা তাদের ধর্মের বলি দিয়েছিলেন তাদের ধর্মীয় দেবতাদের পুজার উদ্দেশ্যে। কে বলে তারা দেশপ্রেমিক?
কেটে কুটে যতটুকু বাংলা আমরা পেয়েছিলাম সেখানে যারা বসবাস করতো তাদের অধিকাংশই মনে প্রাণে বাঙালী ছিলেন না। তাদের কেউ পশ্চিম পাকিস্তানের ভক্ত, কেউ ভারতের। বাঙালী ছিল অল্পসংখ্য বাংলাভাষী মানুষ, যাদের ধর্ম ছিল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কঠৌর পরিশ্রম করে পরিবারের সদস্যদের জন্য দুবেলা দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থা করা। তারা ভারত বোঝে না, পাকিস্তান বোঝে না, আরবি, ফারসি, উর্দু, সংস্কৃত পালি বোঝে না, তারা বোঝে দুবেলা খাবার পাওয়া চাই।
পশ্চিম পাকিস্তানের চরম দু:শাসন, লুন্ঠন, অবৈধ ক্ষমতা দখল, দ্বৈতনীতি, বিমাতাসুলভ আচরন ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অবশেষে এখানকার অধিকাংশ মানুষই সর্বশেষ উনসত্তর-সত্তর সালে বুঝতে পেরেছিল যে যেমন সত্য তারা মুসলমান, যেমন সত্য তারা হিন্দু কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য তারা আসলে বাঙালী। আসলেই তাদের একটি ভূখন্ড আছে, তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি আছে, শুধু অভাব ছিল নিজের জন্ম ভূমিকে ভালবাসার। তখন তারা এই ভূখন্ডকে, এই ভূখন্ডের মানুষদের ভালবাসতে শুরু করলো। কিন্তু অল্পকিছু মানুষ তখনো ছিল যারা পাকিস্তান প্রেম ছাড়তে পারছিল না। তাদের বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষ এই ভুখন্ডে জন্মগ্রহণ করা সত্বেও তারা এই দেশকে ভালবাসতে পারেনি।
একাত্তরে এই পাক প্রেমিকদের মধ্য থেকে কিছু লোক রাজাকার, আলবদর, আসশামস্ বাহিনী গঠন করে কিভাবে আমাদের স্বাধীনতাকে বাঁধাগ্রস্থ করেছিল, কিভাবে নিজ জন্মভূমির মানুষের উপর অমানুষিক নির্যাতন করেছিল তা সবারই জানা আছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশকে ভালবাসে, তারা দেশকে গড়ে তোলার জন্য উদ্যোম নিয়ে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই সব পাক প্রেমিকরাতো পাকিস্তানে ফেরত যায়নি। তাদের বংশধরেরাও তো এই দেশেই বসবাস করছে। আজও তারা ঘৃর্ণা করে বাংলাদেশকে, মনে প্রাণে ভালবাসে পাকিস্তানকে। আবার এমন কিছু লোকও এই দেশে বসবাস করে যে কারণেই হোক তারা এদেশে বসবাস করলেও মনে মনে তারা ভালিবাসে ভারতকে। সেখানেই অর্থ বিনিয়োগ করে। অবশিষ্ট আমরা যারা আছি তারা বিশ্বাস করতে চাই আমরা বাঙালী, এই দেশ আমাদের, এই দেশেরে আলোবাতাস আমাদের, এই দেশের নদনদী, পাহাড় পর্বত, সাগর, বন সবই আমাদের। আমাদের দেশকে আমরা ভালবেসে যাব যতক্ষণ প্রাণ থাকে দেহে। আর একই সাথে ঘৃর্ণা করি তাদেরকে যারা বংশ পরস্পরায় এদেশে জন্মগ্রহণ করা সত্বেও এদেশকে ভালবাসে না, বরং শত্রুতা করে দেশের সাথে, আর ভালবাসে তাদের প্রিয় ভারতকে অথবা পাকিস্তানকে। ঘৃর্ণা করি তাদের যারা বাঙালী শব্দকে ভালবাসে না, বাংলা ভাষাকে ভালবাসে না, ভালবাসে হিন্দি, সংস্কৃত, উর্দ্দু, আরবি, ফারসি আর ইংরেজী ভাষাকে।